| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক উপমহাদেশ বিজেপি-বিরোধী জোটের নামকরণ ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে যতো বিতর্ক


বিজেপি-বিরোধী জোটের নামকরণ ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে যতো বিতর্ক


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     20 July, 2023     08:28 AM    


ভারতে কংগ্রেসসহ মোট ২৬টি বিরোধী দল মিলে বেঙ্গালুরুতে তাদের কনক্লেভ থেকে জোটের নতুন নাম ‘ইন্ডিয়া’ ঘোষণা করার পর চব্বিশ ঘন্টা না-পেরোতেই এই নামকরণ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। যদিও এই ইন্ডিয়াকে তারা ‘অ্যাক্রোনিম’ বা একটি শব্দবন্ধের সংক্ষিপ্ত রূপ বলে দাবি করেছে, কিন্তু কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে দেশের ইংরেজি নাম অনুসারে নিজেদের জোটের নামকরণ করতে পারে কি না, অনেকেই সে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এমন কী আদালতেও এই নামকরণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তাছাড়া বিরোধী জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই যে এই নামে আপত্তি ছিল, সেটাও এখন ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এবং বামপন্থী দলগুলোর এই ‘ইন্ডিয়া’ নামটি একেবারেই পছন্দ ছিল না এবং তারা বৈঠকে সেটা নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিলেন। ‘ইন্ডিয়া’ নামটি কে প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।

বৈঠকে যোগ দেয়া বিরোধী নেতারা কেউ এর ‘কৃতিত্ব’ দিচ্ছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে, কেউ আবার বলছেন এটি তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মস্তিষ্কপ্রসূত। এমন কী ইন্ডিয়ার ‘ডি’ শব্দটি ‘ডেমোক্র্যাটিক’ না কি ‘ডেভেলপমেন্টালে’র সংক্ষিপ্ত রূপ, বিরোধী নেতাদের নানা ধরনের টুইট তুলে ধরে অনেকে সেই অসঙ্গতির দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ওদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপিও বিরোধী জোটের ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণ নিয়ে তীব্র আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে।

ভারতে নিষিদ্ধ ইসলামি ছাত্র সংগঠন ‘সিমি’-র সঙ্গে বিরোধীদের তুলনা করে বিজেপি নেতা অমিত মালভিয়া টুইট করেছেন, “নিষিদ্ধ হওয়ার পর সিমি-র মৌলবাদীরা যেমন নতুন নামে আবার দল বাঁধার চেষ্টা করেছিল কিন্তু নিজেদের চরিত্র বদলায়নি – ঠিক সেভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত ইউপিএ আবার নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে।”

এই পটভূমিতেই আগামিকাল (বৃহস্পতিবার) ভারতের সদ্য উদ্বোধন হওয়া নতুন পার্লামেন্ট ভবনে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে, আর সেখানেই হবে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রথম পরীক্ষা।

‘ইন্ডিয়া’তে যাদের আপত্তি
বিহারের জনতা দল (ইউনাইটেড) সূত্রে এখন বলা হচ্ছে, তাদের নেতা নীতিশ কুমারের প্রথম থেকেই ইন্ডিয়া নামটি পছন্দ ছিল না। ব্যাঙ্গালোরের বৈঠকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তবু বলেছিলেন, ইন্ডিয়া নাম দিলে সেটা অনেকটা বিজেপির জোট ‘এনডিএ’-র মতোই শোনাবে। তা ছাড়া কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে কীভাবে দেশের নামে নিজেদের নাম দিতে পারে, সে প্রশ্নও তোলেন। জোটের নাম বরং ‘ইন্ডিয়া মেইন ফ্রন্ট’ বা ‘ইন্ডিয়া মেইন অ্যালায়েন্সে’র মতো কিছু রাখলেই ভাল হয়। আপনারা সবাই যখন চাইছেন, তখন ওই নামটিই (ইন্ডিয়া) তাহলে থাক!

বৈঠকে তাঁকে তখন মনে করিয়ে দেয়া হয়, ‘ইন্ডিয়া’ আর ‘এনডিএ’ মোটেই এক জিনিস নয় – ইন্ডিয়া শব্দের আগে একটা স্পষ্ট ‘আই’ আছে, যা দুটোকে আলাদা করবে।

বামপন্থী দলগুলো তখন আবার বলে এর মধ্যে প্রথম নামটি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের জোটকে লোকে ‘আইএমএফ’ নামে চিনবে - যেটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআইয়ের ডি রাজা কিংবা সিপিআইএমএলে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যর মতো নেতারা ‘ইন্ডিয়া’ নামটিতেও সায় দিতে পারেননি। তারা জোটের বিকল্প নাম হিসেবে ‘সেইভ ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স’ কিংবা ‘উই ফর ইন্ডিয়া’-ও প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ দলই ‘ইন্ডিয়া’র অনুকূলে মত দেওয়ার পর নীতিশ কুমার বা বামপন্থী নেতাদেরও শেষ পর্যন্ত তাতে নিমরাজি হতে হয়।

বৈঠকের পরে যে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় সেখানে কিন্তু নীতিশ কুমার উপস্থিত থাকেননি। কংগ্রেস দাবি করেছে, ফেরার বিমান ধরার তাড়া ছিল বলেই তাঁকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তবে বিহারের বিজেপি নেতা সুশীল কুমার মোদীর বক্তব্য, জোটের আহ্বায়ক হিসেবে নীতিশ কুমারের নাম ঘোষণা না-হওয়াতেই ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেন।

‘ইন্ডিয়া’ কার ব্রেইনচাইল্ড?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণ কার মাথা থেকে বেরিয়েছে, তার উত্তরে অন্তত তিনজন দাবিদার পাওয়া যাচ্ছে। এই তিনজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি, কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী এবং শিবসেনা (উদ্ধব) গোষ্ঠীর নেতা উদ্ধব বালাসাহেব ঠাকরে। বৈঠকে যোগ দেওয়া তামিলনাডুর দল ভিদুথালাই চিরুথাইগাল কাচ্চির প্রধান থল থিরুমাভালান বলেছেন, “জোটের নাম ইন্ডিয়া রাখা হোক, এটা প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন মমতা ব্যানার্জিই। লম্বা আলোচনার পর সেটাই চূড়ান্ত হয়।”

কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে লিখেছে, এই ‘ইন্ডিয়া’ নামটি স্থির করার পেছনে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন – তাঁর ভাইপো ও এমপি অভিষেক ব্যানার্জিরও ‘বড় ভূমিকা’ ছিল। প্রসঙ্গত, মি ব্যানার্জিও ব্যাঙ্গালোরের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) নেতা জিতেন্দ্র আওহাদ আবার টুইট করে জানিয়েছেন, ইন্ডিয়া নামটি আসলে রাহুল গান্ধীর আইডিয়া। ব্যাঙ্গালোরের বৈঠকে রাহুল গান্ধীই জোটের নাম ইন্ডিয়া রাখার প্রস্তাব পেশ করেন। সবাই তাঁর সৃষ্টিশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং স্থির হয় আগামী নির্বাচনে আমরা সবাই ইন্ডিয়া নামেই লড়ব।

মহারাষ্ট্রের কয়েকটি খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেল আবার দাবি করছে, বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি প্রথম শোনা গিয়েছিল শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরের মুখেই। তবে তিনি ইন্ডিয়া-র সঙ্গেই একটি হিন্দি ‘ট্যাগলাইন’ও যুক্ত করার পরামর্শ দেন, সেই অনুযায়ী পরে ইন্ডিয়ার সঙ্গেই লেখা হয় ‘জিতেগা ভারত’ (ভারতই জিতবে)।

ঘটনাপরম্পরার আরো একটি ভার্সনও পাওয়া যাচ্ছে, যাতে বলা হচ্ছে যদিও ‘ইন্ডিয়া’ নামটি রাহুল গান্ধীরই আইডিয়া – স্থির হয়েছিল যে বৈঠকে প্রথম বক্তা মমতা ব্যানার্জিই এটি সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করবেন। সাংবাদিক বৈঠকে যখন এই নামকরণ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল, মমতা ব্যানার্জি তখন পাশে বসা রাহুল গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে ‘আমাদের প্রিয় রাহুল গান্ধী’ বলেও সম্বোধন করেন।

‘ইন্ডিয়া’ বনাম ‘ভারত’
বিরোধী জোটের এই নামকরণ এদেশে আসলে একটি বহু পুরনো বিতর্ককে উসকে দিয়েছে – আর সেটা হল ‘ইন্ডিয়া’ বনাম ‘ভারত’। ইন্ডিয়া বলতে দেশের আধুনিক, শিল্পসমৃদ্ধ, উচ্চশিক্ষিত, আর্বান, বহির্মুখী অংশটিকে বোঝানো হয় – আর ‘ভারতে’র পরিচিত ন্যারেটিভটা হল দেশের গ্রামীণ ও পিছিয়ে থাকা, কৃষিপ্রধান হিন্টারল্যান্ড। দেশের সরকার তাদের নীতি নির্ধারণে ও কর্মসূচীর রূপায়নে এই ভারত না ইন্ডিয়া – কাকে প্রাধান্য দেবে, সেই আলোচনাও দেশের পলিটিক্যাল ডিসকোর্স বা রাজনৈতিক সংলাপে বারে বারেই উঠে এসেছে। ঠিক এই পটভূমিতেই গতকাল (মঙ্গলবার) বিরোধীরা তাদের জোটের নাম ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই বিজেপি নেতা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা টুইট করেন, “কংগ্রেস যদি ইন্ডিয়ার পক্ষে, তাহলে মোদীজি হলেন ভারতের।”

কিন্তু এই মন্তব্য অনাবশ্যক বিতর্ক ডেকে আনতে পারে, এটা অনুধাবন করেই তিনি কিছুক্ষণ পরেই সেই টুইট ডিলিট করে দেন।

বিজেপি নেতারা এখন ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, বিরোধীরা তাদের জোটের খুশি নাম দিতে পারেন – কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকার যেমন ইন্ডিয়ার, তেমনি ভারতেরও। আগেও ছিলেন, এখনও থাকবেন। বিজেপি বরং এখন দেখানোর চেষ্টা করছে, বিরোধীরা এখন যতই নতুন নামের মোড়কে নিজেদের পেশ করুন না কেন, এটা আসলে আগের সেই দুর্নীতিগ্রস্ত ইউপিএ-রই নতুন অবতার – তাদের কথায় ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’। এই কারণেই বিজেপি ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে এখন নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী ছাত্র সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ারও (পিএফআই) তুলনা করছে।

বলা হচ্ছে, পিএফআই-য়ের মতো নতুন নামের আড়ালে সংঘবদ্ধ হয়েও মৌলবাদী ‘সিমি’ যেমন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারেনি, এখন নতুন মোড়কে ‘ইন্ডিয়া’রও সেই একই পরিণতি হবে। তবে ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণ নিয়ে দেশ জুড়ে যে আলোচনা বা তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে কংগ্রেস সেটাকে ইতিবাচক লক্ষণ বলেই মনে করছে।

ব্যাঙ্গালোরের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন সিনিয়র কংগ্রেস নেতা এদিন বলছিলেন, ইন্ডিয়া নামটা যেরকম সাড়া ফেলেছে তাতে আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য অবশ্যই সফল। দেখাই যাচ্ছে এনডিএ ভয় পেয়েছে, আর মানুষ এই নামটাকে পছন্দ করছেন। বিরোধী জোটের নাম ‘অমুক ফ্রন্ট’ বা ‘তমুক অ্যালায়েন্স’ রাখলে কখনোই শুরুতে এতটা হইচই ফেলে দেওয়া যেত না, যতটা ইন্ডিয়া পেরেছে। আমি তো বলব ইন্ডিয়া প্রথম বলেই ছ্ক্কা হাঁকিয়েছে!”


সূত্র : বিবিসি বাংলা